মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি (নতুন সংস্করণ) - প্রবন্ধ | NCTB BOOK

মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার

ভূমিকা: বর্তমান সময়ে মাদকাসক্তি এক ভয়বাহ বৈশ্বিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। অপার সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজের জন্য মাদকাসক্তি এখন এক মরণফাঁদ। এই ঘাতক ব্যাধিতে আসক্ত হবার ফলে সমাজ হচ্ছে কলুষিত এবং দেশ, জাতি ও পৃথিবীর জন্য অপেক্ষা করছে মর্মান্তিক পরিণতি। তাই একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য, আলোকিত আগামীর জন্য মাদকাসক্তির মতো মরণথাবা থেকে তরুণ ও যুব সমাজকে রক্ষা করা একটি অবশ্যকর্তব্য বিষয়।

মাদক ও মাদকাসক্তি: মাদকদ্রব্য হলো প্রাকৃতিকভাবে অথবা রাসায়নিকভাবে উৎপন্ন পদার্থ যা নেশা তৈরি করে। এসব পদার্থ যারা সেবন করে তাদেরকে মাদকাসক্ত বলা হয়। মাদক সেবনের উগ্র আকাঙ্ক্ষাকে বলা হয় মাদকাসক্তি। মাদকাসক্তি এমন এক নেশা যাতে একবার জড়িয়ে পড়লে, তা থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যায় না। এর পরিণতি অকালমৃত্যু। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য রয়েছে। কিছু কিছু মাদকদ্রব্য ব্যথানাশক ও চেতনানাশক হিসেবে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ মাদকই নেশাকারী পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সিগারেট, মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, মরফিন, কোকেন, চরস, পপি, মারিজুয়ানা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য মাদক। এগুলোর বেচা-কেনা বাংলাদেশে অবৈধ। তা সত্ত্বেও গোপনে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এগুলোর কেনা-বেচা চলে। তরুণ সমাজের বড়ো একটি অংশ এসব মাদক গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজেদের ধ্বংস করার খেলায় মেতে ওঠে।

মাদকের উৎস: মাদকের উৎস বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাদক উৎপাদিত হয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি অসাধু মুনাফালোভী বিশাল চক্র। মাদকের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন, চোরাচালানও হয় অনেক দেশে। থাইল্যান্ড-মায়ানমার-লাওস (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল), আফগানিস্তান-ইরান-পাকিস্তান (গোল্ডেন ক্রিসেন্ট) মাদক চোরাচালানের প্রধান অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। মাদকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলো আফিম। পপি নামক উদ্ভিদ থেকে আফিম তৈরি হয়। আফিম থেকে তৈরি হয় 'মরফিন বেস'। মরফিন বেস থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় হেরোইন। ব্রাজিল, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, ইকুয়েডোর প্রভৃতি দেশে মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানের বড়ো একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এই নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।

মাদকাসক্তির কারণ: জীবনের হতাশা ও দুঃখবোধ থেকে সাময়িক স্বস্তি লাভের আশায় মানুষ প্রথমবার মাদক গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়। অনেকে অন্যের প্ররোচনায় মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে। অনেকে কৌতূহলবশতও প্রথমবার মাদক গ্রহণ করে থাকে। তবে যেভাবেই হোক, কেউ একবার মাদক গ্রহণ করলে সেই আসক্তি থেকে বের হওয়া তার পক্ষে কঠিন হয়। সেই সুযোগে বিপথগামী কিছু মানুষ এবং বহুজাতিক মাদক সংস্থাগুলো অবৈধ অর্থের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে।

পাশ্চাত্যের মাদক উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা এশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোতে ব্যবসা করতে বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করছে। করিডোর হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য অনেকটা সহজলভ্য। এই সুযোগে কিছু অসাধু লোক এখানেও একটি মাদকের বাজার সৃষ্টি করেছে। এইসব খারাপ লোকের চেষ্টায় বর্তমান বাংলাদেশে মাদকাসক্ত লোকের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে।

মাদকাসক্তির কুফল: মাদকে আসক্ত ব্যক্তির বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়, ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতি কমে যায়, নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়, দেহের ওজন কমতে থাকে, হাসি-কান্নার বোধ ও বিচারবুদ্ধি থাকে না; এক পর্যায়ে সে জীবনস্মৃত অবস্থায় পৌঁছে যায়। মাদকের মূল্য বেশি হওয়ায় খুব অল্প দিনেই মাদকাসক্তের সঞ্চিত অর্থ ফুরিয়ে যায়। তখন তারা অবৈধ উপায়ে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। ক্রমে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা এভাবে নিজেদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের সুস্থতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এদের নৈতিক অধঃপতন সমাজের অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। ফলে গোটা সমাজেই পচন ধরতে শুরু করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহের কারণ হয়। অশান্তির জের ধরে বহু মাদকাসক্ত এক পর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। পরিবার ও সমাজের জন্য সেই ক্ষতি অপূরণীয়। এছাড়া সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, মাদকাসক্ত নারী-পুরুষের মধ্যে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী লোক বেশি। অথচ দেশের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য এই বয়সী লোক সবচেয়ে উপযুক্ত। আবার এই বয়সের নারীরাই সবচেয়ে বেশি প্রজননক্ষম। তাই এই বয়সের নারী-পুরুষ মাদকাসক্ত হওয়ার অর্থ হলো, একদিকে দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা, অন্যদিকে সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করা।

মাদকাসক্তির প্রতিকার: মাদকাসক্তির সর্বনাশা প্রভাব থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। সকলেই ভাবছেন, কেমন করে এর করাল গ্রাস থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়। ইতিমধ্যেই দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করছে। বাংলাদশেও মাদকবিরোধী একাধিক সংগঠন কাজ করছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোতে মাদক গ্রহণ ও বিস্তার প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারণা লক্ষ করা যায়। সরকারের সমাজসেবা কর্মসূচিতে মাদক প্রতিরোধ ও মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন কার্যক্রম চালু আছে এবং এদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

মাদকের হাত থেকে দেশের যুবসমাজকে বাঁচাতে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হলো প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং সেখানে বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করা। অন্তত বেকারত্বের হতাশা থেকে যেসব মাদকাসক্তির ঘটনা ঘটে, এর ফলে তা দূর হবে। তবে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হলো মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানকে নির্মূল করা। এজন্য দরকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা রেখে কঠোর আইন প্রণয়ন করা এবং তা প্রয়োগ করে দেখানো।

উপসংহার: মাদকাসক্তির কারণে সমাজের কোনো এক জায়গায় অশান্তি সৃষ্টি হলে, সেই অশান্তি গোটা সমাজকে গ্রাস করতে পারে। তাই মাদকাসক্তিকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় মনে করলে চলবে না। যে তরুণ সমাজ দেশের ভবিষ্যৎ, তারা যদি সুস্থতার মধ্য দিয়ে বড়ো হয়, তাহলেই তারা সুস্থ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবে, অন্যথায় নয়। তাই মাদকের করালগ্রাস থেকে দেশ ও সমাজকে বাঁচাতে হবে।

Content added By
Promotion